নাগরিকত্ব যাচাই নিয়ে জাতীয় বিতর্ক
আধার কার্ড নাগরিকত্ব প্রমাণ নয় – সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সোনালিবিবির মানবিক সংকট
কলকাতা, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫:
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আবারও পরিষ্কার জানিয়ে দিল — আধার কার্ড নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বৈধ নথি নয়। বিহারের ভোটার তালিকার সংশোধন সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আদালত বলেছে, ভোটার তালিকার সঙ্গে সংযুক্ত নথির তালিকায় আধার কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু তা নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। আদালতের এই রায় দেশজুড়ে নাগরিকত্ব যাচাই নিয়ে চলমান বিতর্কে এক নতুন দিশা এনে দিলেও মানবাধিকারের প্রশ্নে উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
✅ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিস্তারিত
শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ করেছে যে, আধার কার্ড শুধুমাত্র একটি পরিচয়পত্র। এটি সরকারি পরিষেবা গ্রহণের জন্য ব্যবহারযোগ্য হলেও নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে এটি গ্রহণ করা যায় না। আদালত স্পষ্ট করেছে—
- ভোটার তালিকা সংশোধনের ক্ষেত্রে আধার কার্ডের ব্যবহার সীমিত।
- নাগরিকত্ব নির্ধারণের জন্য অন্যান্য প্রমাণপত্র প্রয়োজন।
- নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে ভোটার তালিকা সঠিক রাখা, নাগরিকত্ব যাচাই করা নয়।
আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের রায় নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে, কিন্তু মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের নীতিকে আরও কঠোরভাবে যাচাই করতে বাধ্য করবে।
✅ কলকাতা হাই কোর্টে সোনালির মামলা – স্থগিতের কারণ
সোনালিবিবির মামলা কলকাতা হাই কোর্টে শুনানির তালিকায় থাকলেও আইনজীবী সংগঠনের ধর্মঘটের কারণে শুনানি স্থগিত করা হয়। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে দ্রুত শুনানি করে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। মঙ্গলবার পুনরায় মামলার শুনানি হবে বলে জানানো হয়েছে।
✅ সোনালিবিবির মানবিক কাহিনি – এক গভীর সংকট
সোনালিবিবির জীবন শুরু হয়েছিল বীরভূম জেলার এক দরিদ্র গ্রামে। স্বামী দানিশ ও একরত্তি সন্তানকে নিয়ে জীবিকা সন্ধানে তিনি দিল্লিতে গিয়েছিলেন। সেখানে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু করেন। তাঁরা কাগজ কুড়ানো, ইট ভাঙা, দৈনিক মজুরি শ্রমিক হিসেবে জীবন কাটাতেন।
আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড থাকলেও নাগরিকত্ব যাচাই অভিযানে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। বাংলায় কথা বলা, স্থানীয় পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের ভ্রান্ত ধারণায় তাঁদের আটক করা হয় এবং পরে অসম সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে না পারায় তাঁকে আটক রেখে জেলখানায় পাঠানো হয়। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালিবিবির চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং মানবিক অধিকার কোথায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর সন্তানের ভবিষ্যৎ আজ ঝুলে আছে।
✅ নাগরিকত্ব যাচাই নিয়ে জাতীয় বিতর্ক
দেশজুড়ে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান শুরু হওয়ার পর বহু দরিদ্র শ্রমিক, পরিযায়ী পরিবার এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে না পারায় ভীতির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে যারা বাংলায় কথা বলে, যাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই বা যারা দরিদ্র জীবিকা নিয়ে বেঁচে আছে তাদের ওপর সন্দেহের তির নির্দেশ করা হয়েছে।
✅ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক মহলে এই রায় নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। শাসকদল বলছে, আদালতের রায় নির্বাচন কমিশনের অবস্থানকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে বিরোধীরা অভিযোগ করছেন যে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযানে দরিদ্র মানুষকে হয়রানির মুখে ফেলা হচ্ছে।
✅ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নাগরিকত্বহীনতার কারণে মানবাধিকারের লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রশ্নে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
✅ সামনে কী হওয়া উচিত?
- নাগরিকত্ব যাচাইকে মানবাধিকার রক্ষার কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।
- আধার কার্ডকে নাগরিকত্ব প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
- প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আইনি সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
- অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
- বিচারালয় দ্রুত শুনানির মাধ্যমে নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করতে পারে।
✅ উপসংহার
সুপ্রিম কোর্টের রায় নাগরিকত্ব যাচাইয়ে নতুন দিশা দিলেও সোনালিবিবির কাহিনি দেখিয়ে দিয়েছে বাস্তব জীবনে এই নীতির কী ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহের নামে দরিদ্র পরিবারগুলো অনিরাপদ জীবনের মুখে পড়ছে। আদালতের নির্দেশের আলোকে প্রশাসনের উচিত স্বচ্ছতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়াকে গড়ে তোলা। নাগরিকত্বের অভাব একদিনের সমস্যা নয়—তা এক জীবনের অস্তিত্ব, এক শিশুর ভবিষ্যৎ, এক সমাজের মর্যাদার প্রশ্ন।
");

