বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহরের শীর্ষে দিল্লি — IQAir রিপোর্ট ২০২৫
বিশ্বের দূষিত শহরের শীর্ষে দিল্লি
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এয়ার কোয়ালিটি ফার্ম IQAir-এর প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহর হিসাবে শীর্ষে উঠে এসেছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিল্লির বায়ুতে PM2.5 কণার মাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র নির্ধারিত নিরাপদ সীমার ২০ গুণেরও বেশি। এ তালিকায় ভারতের আরও দুই শহর— মুম্বই ও কলকাতা— রয়েছে যথাক্রমে পঞ্চম ও অষ্টম স্থানে।
- বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দিল্লি ১ নম্বরে।
- মুম্বই পঞ্চম এবং কলকাতা অষ্টম স্থানে।
- দিল্লির PM2.5 মাত্রা WHO গাইডলাইন থেকে ২০ গুণ বেশি।
- বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতিবছর ভারতে ১৫ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয় (গবেষণা অনুসারে)।
দিল্লির বায়ু এত দূষিত কেন?
দিল্লির বায়ুদূষণের কারণ একাধিক। শহরটি ঘিরে থাকা পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় ফসল কাটার পরে ব্যাপক হারে স্টাবল বার্নিং বা খড় পোড়ানো হয়। এতে বায়ুমণ্ডলে বিশাল পরিমাণ ধোঁয়া ও ক্ষুদ্র কণা ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি দিল্লির নিজস্ব যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে— প্রতিদিন প্রায় এক কোটি যান শহরের রাস্তায় চলে। যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলিকণা, কারখানার ধোঁয়া এবং শীতকালে তাপমাত্রা কমে বাতাসের গতি হ্রাস— সব মিলিয়ে বায়ুতে ক্ষতিকর কণার ঘনত্ব বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত আসলেই দিল্লির উপরে এক ধরনের "ধোঁয়াচ্ছন্ন ছাদ" তৈরি হয় যা দূষণকে আটকে রাখে। ফলে শহরের আকাশ কালচে ধূসর রঙে ঢেকে যায় এবং নাগরিকদের শ্বাস-প্রশ্বাসে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করে।
মুম্বই ও কলকাতার অবস্থাও উদ্বেগজনক
মুম্বই— ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী—ও এখন বায়ু দূষণের বড় শিকার। গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজ ও সমুদ্রতীরবর্তী শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত ধোঁয়া সেখানে দূষণের বড় উৎস। একইভাবে কলকাতায় শীতকালে PM2.5 এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ট্র্যাফিক, পুরনো ডিজেলচালিত যানবাহন, ইটভাটা ও শিল্প এলাকা থেকে নির্গমন শহরের বায়ুমান নষ্ট করছে।
স্বাস্থ্যের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব
চিকিৎসকদের মতে, বায়ু দূষণ বর্তমানে ভারতের অন্যতম প্রধান ‘নীরব ঘাতক’। দীর্ঘমেয়াদে দূষিত বায়ু শ্বাসযন্ত্রের মারাত্মক রোগ যেমন— ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, COPD— বাড়ায়। শিশুদের ফুসফুসের বিকাশ ব্যাহত হয়, গর্ভবতী নারীদের গর্ভস্থ শিশুর উপরও এর প্রভাব পড়ে। এছাড়া হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
বিশ্বব্যাপী গবেষণা অনুসারে, প্রতি বছর শুধুমাত্র ভারতেই বায়ুদূষণজনিত কারণে ১৫ লক্ষাধিক মানুষ অকালে প্রাণ হারান। এর মধ্যে দিল্লির অবদান সবচেয়ে বেশি। অনেক পরিবারই শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা, মাথাব্যথা ও চর্মরোগে ভুগছেন।
সরকারি পদক্ষেপ ও তার সীমাবদ্ধতা
দূষণ রোধে দিল্লি সরকার ও কেন্দ্র যৌথভাবে GRAP (Graded Response Action Plan) চালু করেছে। এর আওতায় স্কুল বন্ধ, নির্মাণকাজে নিষেধাজ্ঞা, ডিজেল গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ, ও শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন কমানোর মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি নাগরিকদের public transport ব্যবহার ও গাছ লাগানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পদক্ষেপ অনেক সময় "অস্থায়ী" সমাধান হিসেবে দেখা হয়। মূল সমস্যাগুলির মধ্যে— ফসল পোড়ানো, পুরনো গাড়ির চলাচল ও দূষণ নিরীক্ষার দুর্বলতা— এখনো রয়ে গেছে। শীত শেষে এই প্রচেষ্টা প্রায়ই ঢিলে হয়ে যায়।
জনসচেতনতা ও নাগরিক করণীয়
- বায়ু মান সূচক (AQI) প্রতিদিন দেখে বাইরে বেরোন।
- বাইরে কাজের সময় N95 বা FFP2 মাস্ক ব্যবহার করুন।
- ঘরে HEPA ফিল্টারযুক্ত এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করুন।
- গাছ লাগান ও অপ্রয়োজনে গাড়ি ব্যবহার কমান।
- ধূমপান বর্জন করুন, কারণ তা ঘরের ভিতরের বায়ুকেও দূষিত করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ দিক
পরিবেশবিদরা বলছেন, ভারতের এই পরিস্থিতি কেবল দেশীয় নয়, বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণ। কারণ ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। এখানে বায়ুদূষণ বাড়লে তা দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক আবহাওয়া ও জলবায়ুকেও প্রভাবিত করতে পারে। ইউএন ও বিশ্বব্যাঙ্ক ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে যে, বায়ুদূষণ যদি এই হারে বাড়তে থাকে, তবে ভারতের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা আগামী দশকে ৯% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
পরিবেশবিদরা আরও পরামর্শ দিচ্ছেন যে, শহর পরিকল্পনা, সবুজ এলাকা বৃদ্ধি, পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তঃরাজ্য পর্যায়ে কৃষিক্ষেত্রে বিকল্প ফসল অবশিষ্ট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পোড়ানোর দরকার না পড়ে।
উপসংহার
বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহরের তালিকায় দিল্লির শীর্ষে অবস্থান কেবল এক শহরের নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ সংকটের প্রতীক। মুম্বই ও কলকাতার অবস্থানও দেখিয়ে দিচ্ছে যে ভারতের শহরগুলো এখন বায়ু দূষণের এক জটিল বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার, নাগরিক, শিল্প ও কৃষি— সকলেরই যৌথ দায়িত্ব রয়েছে। এখনই যদি দৃঢ় পদক্ষেপ না নেওয়া যায়, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য শ্বাস নেওয়াই হয়ে উঠবে বিলাসিতা।



No comments:
আপনার মতামত এর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ 👇
👉 যদি মনে হয় বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, পোস্টটি শেয়ার করুন 🔄নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন